1. kazi.rana10@gmail.com : Sohel Rana : Sohel Rana
  2. jmitsolution24@gmail.com : support :
বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ০২:২২ অপরাহ্ন

গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ মামলায় গ্রেফতার ৩৩৪, এখনও কাটেনি আতঙ্ক

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি
  • Update Time : শুক্রবার, ২৫ জুলাই, ২০২৫
  • ৩৮ Time View

গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় আরও দুটি মামলা হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ১০টি মামলা হলো। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ৩৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনও জনমনে গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। এজন্য শহরের বেশিরভাগ এলাকা পুরুষশূন্য।

সবশেষ গত মঙ্গলবার রাতে টুঙ্গিপাড়া থানায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি এবং জেলা কারাগারের জেলার বাদী হয়ে সদর থানায় আরেকটি মামলা করেন। দুটি মামলায় ২৪২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা এক হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোহাম্মদ সাহেদুর রহমান ও টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি খোরশেদ আলম মামলার দুটির বিষয় জানিয়েছেন। পুলিশ জানায়, টুঙ্গিপাড়ায় সড়ক অবরোধ করে আতঙ্ক তৈরির অভিযোগে টুঙ্গিপাড়া থানার উপপরিদর্শক মো. মনির হোসেন বাদী হয়ে টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি নুরুল ইসলাম শেখ, সাধারণ সম্পাদক ইফতি জামানসহ ৮২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২০০ জনের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) ধারায় মামলা করেন।

অন্যদিকে গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে জেলার তানিয়া জামান বাদী হয়ে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নিউটন মোল্লা, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ১৬০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা এক হাজার জনকে আসামি করে সদর থানায় অন্য মামলাটি করেন। এ নিয়ে গোপালগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়ানোর অভিযোগ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১০টি? মামলা হলো। সদর, কাশিয়ানী, টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া থানায় মামলাগুলো করা হয়।

১০টি মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৬০০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা নয় হাজার ২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে এখনও জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যৌথ বাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছেন। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ১০ মামলায় ১৬ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৩৩৪ জনকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে সদর থানায় নতুন ১১ জনসহ ১১২ জন, কাশিয়ানীতে ৭৭ জন, মুকসুদপুরে ৮৮ জন, টুঙ্গিপাড়ায় ২৯ জন ও কোটালীপাড়ায় ২৮ জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

৯ দিন পেরিয়ে গেলেও জনজীবনে স্বস্তি আসেনি
শহরের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার নয় দিন পেরিয়ে গেলেও জনজীবনে স্বস্তি আসেনি। কমবেশি সবার মাঝে গ্রেফতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে জেলা শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ খোলা আছে। যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক আছে। তবে যাত্রী নেই। শহরের সব জায়গায় উপস্থিতি কম মানুষের। দোকানপাটে নেই আগের মতো ভিড়। ভয় ও গ্রেফতার আতঙ্কে সাধারণ মানুষজন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।

শহরের বাসিন্দা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ঘটনার দিন গোপালগঞ্জ আদালতে পারিবারিক জমি নিয়ে বিরোধের এক মামলায় হাজিরা দিতে গিয়েছিলাম। হাজিরা দিতে বিকাল ৫টা বেজে যায়। ওই দিন রাতে বাড়ি ফিরি। গত বুধবার সন্ধ্যায় বাড়ি এসে জানতে পারি গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলার ঘটনায় করা মামলায় আমাকে ২১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এখন আমি গ্রেফতার আতঙ্কে আছি। একই আতঙ্কের কথা জানিয়ে শহরের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স ১৭। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। বাড়ির পাশের মাঠে খেলাধুলা শেষে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পথে তাকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। এরপর আমাকে খবর দেওয়া হলে থানায় গিয়ে দেখি মামলার আসামি করা হয়েছে। আমার ছেলে আইনত অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাকে গোপালগঞ্জ কারাগারে রাখা হয়েছে বড় বড় অপরাধীদের সঙ্গে। আমি এর বিচার চাই।’

গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত
বৃহস্পতিবার বিকালে গোপালগঞ্জ সদর থানার সামনে গিয়ে দেখা যায়, অনেক মানুষের ভিড়। থানার মূল ফটকে তালা দেওয়া। খোলা রয়েছে পকেটগেট। থানায় এত লোক জড়ো হওয়ার কারণ জানতে চাইলে এক ব্যক্তি বলেন, ‘কোটালীপাড়া থেকে গোপালগঞ্জে আসার পথে আমার মামাতো ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার খোঁজ নেওয়ার জন্য থানায় এসেছি। এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। একই থানার সামনে মুন্নি বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক আগেই মারা গেছেন। আমার একমাত্র সন্তান ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। গত বুধবার ছেলে বাসায় খেতে আসার পর শহরের কুয়াডাঙ্গা থেকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। আমি তার জন্য কিছু খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ। আমার ছেলে নিরপরাধ। আমি তার মুক্তি চাই।’

গণগ্রেফতার বন্ধের আহ্বান বিএনপির
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নিরীহ নাগরিকদের হয়রানি না করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন জেলা বিএনপির নেতারা। গত সোমবার বেলা ১১টায় শহরের বড়বাজার পৌর মার্কেটে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তারা এ আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শরীফ রফিকুজ্জামান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব কাজী আবুল খায়েরসহ বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। তারা অভিযোগ করেছেন, গোপালগঞ্জে গণহারে গ্রেফতার চলছে। অবিলম্বে গণগ্রেফতার বন্ধ এবং সাধারণ মানুষকে হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানান তারা। সবশেষ বৃহস্পতিবার রাতে গোপালগঞ্জ শহরের দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা এবং সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক দেখা গেছে। তবে মানুষ খুবই কম। বেশিরভাগ এলাকা পুরুষশূন্য। স্থানীয় লোকজন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গেও কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, খোঁজ পেলেই গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। নিরীহ মানুষকে গ্রেফতার না করার অনুরোধ করেছেন অনেকে।

নিহত তিন জনের লাশ তুলে ময়নাতদন্তের পর দাফন
এ ঘটনায় পাঁচ জন নিহত হন। তারা হলেন- গোপালগঞ্জের থানাপাড়া এলাকার রমজান মুন্সী (৩৫), শহরের উদয়ন রোডের বাসিন্দা সন্তোষ সাহার ছেলে দীপ্ত সাহা (২৫), সদরের ভেড়ার বাজার এলাকার ব্যাপারীপাড়ার ইমন তালুকদার (১৭), টুঙ্গিপাড়ার সোহেল রানা (৩৫) ও সদরের বিসিক এলাকার রমজান কাজী (১৮)।

সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির মোহাম্মদ সাজেদুর রহমান জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে রমজান কাজী, ইমন তালুকদার ও সোহেল রানার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে তোলা হয়েছে গত সোমবার। গোপালগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে লাশগুলো তুলে ময়নাতদন্ত শেষে আবার দাফন করা হয়েছে। কারণ নিহতের পর ময়নাতদন্ত ছাড়া তাদের দাফন করা হয়েছিল। আর রমজান মুন্সী ঢাকা মেডিক্যালে মারা গিয়েছিল। সেখানে তার ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। পরে দাফন করা হয়েছিল। বাকি দীপ্ত সাহার লাশ দাহ করায় ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয়নি।

যা বলছেন নিহতদের স্বজনরা
নিহত রমজান কাজীর মামা রাসেল কাজী বলেন, ‘ঘটনার দিন বিকাল ৩টার দিকে ভাগনে নিহতের খবর পাই। খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে গিয়ে দেখি ভাগনেসহ আরেকজনের লাশ পড়ে আছে। আমরা লাশের ময়নাতদন্ত করার জন্য গোপালগঞ্জ সদর থানায় যাই। সেখান থেকে তারা আবার হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। হাসপাতালে এলে ডাক্তার বলেন, আপনারা লাশ দ্রুত নিয়ে যান। নয়তো পরবর্তীতে সমস্যা হতে পারে। পরে আমরা লাশ হাসপাতাল থেকে এনে শহরের পৌর কবরস্থানে দাফন করি। আমার ভাগনের শরীরে গুলির চিহ্ন ছিল। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল। আমরা এর সঠিক বিচার চাই।’

নিহত ইমন তালুকদারের মামাতো ভাই মোহাম্মদ রানা বলেন, ‘ইমন গোপালগঞ্জ শহরের একটি ক্রোকারিজের দোকানের কর্মচারী ছিল। ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল। বয়স ১৭ বছর। সে কীভাবে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে? সে ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার বাসায় গিয়ে দেখেন পাঁচ কেজি চালও নেই এখন। তার পরিবার খুব কষ্টে আছে। পরিবার মামলা করেনি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে রানা বলেন, ‘ইমনের মা এখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি। আমার ভাইকে মেরেছে পুলিশ। আমরা এখন তাদের বিরুদ্ধে কীভাবে মামলা করতে যাবো? সেখানে আমরা কি নিরাপদে থাকতে পারবো? আমি নিজেও নিরাপদ মনে করছি না। গোপালগঞ্জের বর্তমান যে প্রেক্ষাপট তাতে বাসা থেকে বের হতেও ভয় লাগে। তবে আমার দাবি, ইমনের মতো যেন কাউকে মরতে না হয়।’

ইমনের বাবা বলেন, ‘আমি ছেলেকে হারিয়েছি। কিন্তু কোনও বিচার পাইনি। সেদিন লাশের ময়নাতদন্ত করতে চাইলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিল লাশ নিয়ে যান, না হয় সমস্যা হবে। একজন বাবার পক্ষে সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়া কতটা কষ্টের তা বলে বোঝাতে পারবো না। আমি অসহায় এক বাবা। পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা নেই। তবে ছেলে হত্যার বিচার চাই। জানি না বিচার পাবো কিনা।’

প্রসঙ্গত, ১৬ জুলাই এনসিপির জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলা করেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে শহরের বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রথমে ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। পরে পরিস্থিতি অবনতির কারণে ওই দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে কারফিউ জারি করা হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে প্রথম দফায় কারফিউয়ের মেয়াদ বাড়িয়ে গত শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত করেন। এর মধ্যে শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল ছিল। শুক্রবার সন্ধ্যায় দ্বিতীয় দফায় কারফিউর মেয়াদ বাড়িয়ে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কার্যকর রাখা হয়। এরপর ১৪ ঘণ্টা শিথিল রেখে রাত ৮টা থেকে রবিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউর মেয়াদ বাড়ানো হয়। ওই দিন রাতে কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2023
error: Content is protected !!