মেহের মামুন : ইতালিতে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ট্রলার ডুবে মারা যাওয়া ৮ জনের মধ্যে তিন জনের বাড়ি গোপালগঞ্জে মুকসুদপুর উপজেলায়। মারা যাওয়া এই যুকদের বাড়িতে এখন চলছে শোকের মাতম। সংসারের হাল ধরতে দালালদের মাধ্যমে অবৈধ পথে বিদেশ যেতে গিয়ে সন্তানদের এমন পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না কেউ।গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার গয়লাকান্দি গ্রামের পক্ষঘাতগ্রস্ত পান্নু শেখ অপেক্ষায় রয়েছেন ছেলে ইমরুল কায়েস আপনকে ফিরে পাওয়ার আশায়। তিনি এখনো জানেন না ছেলে বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। কেউ বলেছেন হাসপাতালে আছে। কেউ বলেছে জেলে। পান্নু শেখ বলেন, ‘আমি শুধু আমার ছেলেকে ফিরে পেতে চাই। ছেলেকে ফিরে পেলে আমার কোনো অভিযোগ নেই। ছেলেকে না পেলে তারপর ব্যবস্থা নেব।’ তার একটাই চাওয়া তিনি যেন তার ছেলেকে ফিরে পান।মারা যাওয়া ইমরুল কায়েস আপনের মা কেয়া কামরুন নাহার ছেলের মৃত্যুর খবর পেলেও জানাননি অসুস্থ স্বামীকে। কেয়া কামরুন নাহার ছেলের শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছিলেন না তিনি।
শুধু ইমরুল কায়েস আপনই নয় একই উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের দাদন শেখের ছেলে রিফাত শেখ ও ফতেপট্টি গ্রামের রাসেল শেখও ইতালি যাওয়ার পথে মারা গেছেন।
মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) বিকেল ৫টায় মুকসুদপুর উপজেলার গয়লাকান্দি গ্রামে ইমরুল কায়েস আপনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে শোকের ছায়া। জানা গেছ, বাবা পান্নু শেখ ২০০৪ সালে সৌদি আরবে যান। ১৫ বছর পর ২০১৯ সালে দেশে ফিরে একটি কোম্পানিতে গাড়ি চালকের চাকরি শুরু করেন তিনি। এক বছর আগে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেললে বন্ধ হয়ে যায় আয় রোজগার। তাই সংসারের হাল ধরতে এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বষের্র শিক্ষার্থী ইমরুল কায়েস আপন ইতালি যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন পরিবারের কাছে। পরে রহিম নামের এক দালালকে ১১ লাখ টাকা দিয়ে গত ১০ জানুয়ারি ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠান ছেলে আপনকে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে ট্রলারযোগে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা দেন আপন। ভূমধ্যসাগরে ট্রলার ডুবে আপন মারা যান। তার মৃত্যুর খরর বাড়িতে আসলে নেমে আসে শোকের ছায়া।
পান্নু শেখ সৌদি আরব থাকার সময় ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে স্ত্রী কেয়া কামরুন নাহার পাবনায় বাবার বাড়িতে থাকতেন। ইমরুল কায়েস আপন পাবনাতেই পড়ালেখা করেছেন। সেখান থেকে এসএসসিও এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ—৫ পেয়ে পাস করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ইমরুল কায়েস আপনের বাবা পান্নু শেখ বলেন, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরসহ আশপাশের অনেকেই ইতালি যায়। তাদের সঙ্গে ছেলেকে পাঠিয়েছেন। তাকে পাঠিয়ে এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি। গত ৮ জানুয়ারি এক্সিম ব্যাংকের টেকেরহাট শাখার মাধ্যমে দালাল রহিমের কাছে ১১ লাখ টাকা পাঠাই। রহিম লিবিয়ায় থাকে। তার বাড়ি মুকসুদপুর উপজেলার রাগদী ইউনিয়নের গজনা গ্রাম। জীবনের সঞ্চিত সব সম্বল দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছি।
একই দিনে মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের বড়দিয়া গ্রামের রিফাত শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখাগেছে শোকের মাতম। তার মা সোমা বেগম ছেলের শোকে ষ্ট্রোক করে মৃত্যু শয্যায়। রিফাতের পিতা দাদোন শেখ একজন দিনমজুর। কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন কয়েক বছর হলো। দাদোন শেখ জানান, রিফাত এসএসসি পরিক্ষায় ফেল করে কিছু দিন একটা কোম্পানীতে চাকরী করতো। বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা পোষন করলে, বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন এবং তার শেষ সম্বল ভিটা মাটি বিক্রি করে দালাল রহিমের নিকট ১৪ লাখ টাকা দিয়ে গত ডিসেম্বর মাসের ২৮ তারিখে লিবিয়া পাঠায়। সেখানে যাওয়ার পরে দালাল রহিম জানায় তার ছেলেকে লিবিয়ায় ডাকাতরা তাকে আটকিয়ে রেখেছে। এই কথা বলে তারা আমার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নেয়। ১৫ ফেব্রুয়ারী সকালে আমাদের বোর্ডের ছবি পাঠিয়ে জানায় এই বোর্ডে করে আপনার ছেলেকে ইতালি পাঠানো হচ্ছে। বিকাল ৩টার মধ্যে পৌছানোর কথা ছিলো। পরে তাকে কল করলে তিনি আর কল রিসিভ করেননা। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি ট্রলারডুবীতে আমার ছেলে মারা গেছে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমার দাবি আমার ছেলের লাশটা অন্তত আমাদের কাছে এনে দেক। আর এই দালালদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনা হোক।
উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের ফতেপট্রি গ্রামের রাসেল শেখের বাড়িতে গিয়ে দেখাগেছে শোকের ছায়া নেমে এসেছে পুরো পরিবারসহ এলাকাজুড়ে। তার পিতা কাশেম শেখ স্থানীয় বাজারে চা বিক্রেতা। চা বিক্রি করে কোনরকম দিন চলে তাদের। পরিবারের স্বচ্ছতা ফেরাতে একমাত্র ছেলেকে ইতালি পাঠানোর সিদ্ধান্ত দালালের খপ্পরে পড়ে। গত ২ মাস ১২ দিন আগে দালাল রহিমের মাধ্যমে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে দেশ ছাড়ে রাসেল। লিবিয়াতে বেশ কিছু দিন আটকা ছিলো। আটকা থাকার পরে ঘটনার দিনে ট্রলারে মৃত্যু হয়েছে কি না জানি না তবে দালাল বলছে রাসেল হাসপাতালে ভর্তি এই বলে ফোন বন্ধ করে রাখে এখন ফোন ধরে না । পরিবারের দাবি তাদের ছেলের লাশটা যেন দেশে আসে। আর দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।
মুকসুদপুর থানার ওসি মোহাম্মদ আশরাফুল আলম ঘটনার স্বত্বতা নিশ্চিত করে জানান, ট্রলারডুবীতে মুকসুদপুরের ৩জন নিহত হয়েছে। তাদের বাড়িতে এখন শোকের মাতম চলছে। এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আছে। যে দালালের মাধ্যমে বিদেশ পাড়ি জমিয়ে ছিলো তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।