মো. কামরুল আহসান তালুকদার(পিএএ) ঃ ‘‘Ensure inclusive and equitable quality education and promote lifelong learning opportunities’’ এসডিজি’র এই প্রতিপাদ্য অর্জনে এগিয়ে চলছে প্রাথমিক শিক্ষা। সাধারণভাবে বলা যায়, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। আর শিক্ষা প্রসঙ্গ আসলেই প্রথমত ভাবতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার কথা। আজকের শিশু যেমন আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, ঠিক তেমনি আজকের প্রাথমিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে আগামী দিনের প্রশিক্ষিত প্রজন্ম ‘‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক’’।
স্বাধীনতাত্তোর প্রাথমিক শিক্ষার গুরত্ব উপলব্ধি করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১,৫৭,৭২৪ জন প্রাথমিক শিক্ষকের চাকুরী জাতীয়করণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের উপর এবং তা বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষাকে সাংবিধানিকভাবে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়; দক্ষ মানব সম্পদ বিনির্মাণে। বাংলাদেশে ৬৫,৫৬৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক—শিক্ষিকার সংখ্যা ৩,৬২,৭০৯ জন। মোট ভর্তিকৃত ছাত্র—ছাত্রীর সংখ্যা ২,০৫,৪৬,০৯১ (প্রাক—প্রাথমিক শ্রেণিসহ)। ছাত্র—শিক্ষক অনুপাত ৩৩:১, ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ১৩.১৯ শতাংশ।
প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে বিভিন্ন যুগোপযোগী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজস্ব বাজেট ও বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিক শিক্ষার সম্পসারণ ও উন্নয়নে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছে বা হচ্ছে। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, আইসিটি সামগ্রী ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ, বিনামূল্যে পাঠ্যপু্স্তক বিতরণ. ওয়াশব্লক নির্মাণ ও নলকূপ স্থাপন, আসবাবপত্র প্রদান, শিক্ষক, কর্মকর্তা—কর্মচারীগণকে প্রশিক্ষণ প্রদান। ঝখওচ (ঝপযড়ড়ষ খবাবষ ওসঢ়ৎড়াসবহঃ চষধহ) কার্যক্রমের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, পদ সৃষ্টিসহ শিক্ষক নিয়োগ, দেশব্যাপী শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি বিতরণ, স্কুল ফিডিং, বিদ্যালয় পর্যায়ে স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। জাতীয় টেকসই উন্নয়ন, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, রূপকল্প বাস্তবায়ন, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ বিভিন্ন বিষয়ে লক্ষ্য অর্জনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে এবং সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তথা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
উন্নয়ন পরিকল্পনার অনন্য উদাহরণ ঝখওচ। ঝখওচ কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হয় বিদ্যালয় ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। এসএমসি’র মাধ্যমে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। ফলে বিদ্যালয়ের নিবিড় চাহিদাগুলো দ্রুত পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। স্থানীয় অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমেও কিছু কিছু বিদ্যালয় চমৎকারভাবে বিদ্যালয়ের পরিবেশ অনুকূলে রেখেছে। বলা যায়, প্রতিটি বিদ্যালয়ে শিক্ষা উপকরনসহ অন্যান্য শিখন সামগ্রীর ঘাটতি দূর হয়েছে। আজ প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়েই চকের পরিবর্তে মার্কার, হোয়াইট বোর্ড ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নতুন দিনে প্রবেশ করেছে।
‘‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন’’ এই চেতনাকে ধারণ করে ২০১০ সাল থেকে প্রবর্তন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট। বালক ও বালিকাদের জন্য এ এক অনন্য সুযোগ। এই টুর্নামেন্টে প্রতিটি বিদ্যালয় হতে ২টি করে দল অংশগ্রহণ করে থাকে। ১ লক্ষ ৩০ হাজার দল নিয়ে এতবড় টুর্নামেন্ট আয়োজন বিশ্বের কোথাও নেই। এটি গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পাওয়ার মতো একটি ইভেন্ট। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এক অসাধারণ ইনোভেশন।
জাতীয় শিক্ষা পদক প্রতিযোগিতা প্রবর্তন করে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়ায় অসাধারণ নৈপূন্য প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীরা জাতীয় শিক্ষা পদক অর্জন করে দেশসেরা হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কাবিং কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা হয়। পূর্বে এমন কোন আয়োজন আমাদের সময় ছিল না। প্রকৃত পক্ষেই মনোপেশীজ শিক্ষার এটি একটি অনন্য উদাহরণ।
আধুনিক শিক্ষার জনক জ্যাঁজ্যাক রুশো তার দঊসরষব’ গ্রন্থে শিক্ষার ৩টি উৎসের কথা বলেছেন। প্রকৃতি, মানুষ ও বস্তুজগৎ। শিক্ষার এই তিনটি উৎসের মধ্যে যদি সমন্বয় না ঘটে তবে শিক্ষা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়। ঊফঁপধঃরড়হ ঃযৎড়ঁময হধঃঁৎধষ পড়হংবয়ঁবহপব তত্ত্বের অনুসারেই শিশুর অবাধ বিচরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষালাভ করবে বলে মত দেন। সেই আলোকেই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও জীবন জীবিকার প্রয়োজনে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। ২০১০ সালের শিক্ষানীতির আলোকে প্রণয়নকৃত শিক্ষাক্রম আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হয়েছে। শিক্ষাক্রম বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিক্ষকদের এ প্রশিক্ষণে সরকার প্রায় ২০০কোটি টাকা ব্যয় করছে।
ইংরেজি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সরকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যয়ের কোনো কার্পণ্যতা নেই। বিভিন্ন প্রকল্প ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ আয়োজনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষায় প্রতিনিয়ত আধুনিক জ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে চলেছে।
তবে এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। স্বাধীনতার ৫২বছর পরেও আমরা এখনো মানসম্মত শিক্ষার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। ইইঝ এর এক রিপোর্ট থেকে দেখা যায় বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী কাঙ্খিত মানে উন্নীত হতে পারেনি। এটা আমাদের জন্য সুখকর বিষয় নয়। আমি মনে করি, এক্ষেত্রে শিক্ষকদের আরো আন্তরিক হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে শ্রেণি কক্ষে পাঠদান সময়সূচি আরো বৃদ্ধি করা যায় কিনা সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। কেননা বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে অধিকাংশ ছাত্র—ছাত্রীরা সাবলীল ভাবে পড়তে ও লিখতে সক্ষম নয়। তাদের সক্ষম করে তুলতে পাঠদান সময়সূচিতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এমনও হতে পারে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক একটি দিন নির্ধারণ করে সারাদিন বাংলা বা ইংরেজি বিষয়ে পাঠদানের মাধ্যমে ছাত্র—ছাত্রীদের উক্ত বিষয়ে দক্ষ করে তোলা যায়। মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ এখন সময়ের দাবী। পিএসসি’র মাধ্যমে নন ক্যাডার থেকে শিক্ষক নিয়োগ করা হলে মেধাবীরাই শিক্ষকতায় সুযোগ পাবেন।
করোনা যেমন অভিশাপ তেমনি করোনার কারণে অনেক বিষয়ে আমাদের স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছে। Blending Learning Approach এ পদ্ধতি অবলম্বন করে শিখন ঘাটতির মাত্রা অনেকাংশে হ্রাস করা গেছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষুদে ডাক্তার টিমের ভূমিকায় ছাত্র—ছাত্রীদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রোগ্রাম স্কুল পর্যায়ে এই ক্ষুদে ডাক্তার টিমের দ্বারা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিষয়ে ক্ষুদে ডাক্তার টিমকে আরো কার্যকরী করার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ক ওরিয়েন্টেশন করানো যেতে পারে। শুধু শিক্ষক নয়, ছাত্র—ছাত্রীর সু—স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশিস্নষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রাইমারী হাসপাতাল নির্মাণ করা যেতে পারে। যেখানে শিক্ষা অভিভাবক ছাত্র—ছাত্রীরা স্বল্পমূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারে।
শিশুকাল থেকে শিশু মানসে গণতান্ত্রিক মূলবোধ সৃষ্টি ও চর্চার লক্ষ্যে বিদ্যালয় পর্যায়ে গড়ে তোলা হয়েছে স্টুডেন্ট কাউন্সিল। ছাত্র—ছাত্রীদের সরাসরি ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে স্টুডেন্ট কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত করা হয়।
শিক্ষকদের অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সমন্বয়ে একটি প্রাইমারী ব্যাংক স্থাপন করা যেতে পারে। যাতে খুব সহজেই একজন শিক্ষক বা কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার প্রয়োজনে ঋণ পেতে পারেন। এ জাতীয় আরও কল্যাণ মূলক কাজ করার সুযোগ রয়েছে বলে আমার ধারণা।
বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে সব সময়ই আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নতুন নতুন জ্ঞান, কলা কৌশল রপ্ত করে রুপকল্প ২০৪১ শুধু নয়, ডেল্টাপ্লান বাস্তবায়নেও আমাদের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষার বাতিঘর খ্যাত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এই কাজটি ভালভাবেই করছে। প্রাথমিক শিক্ষায় সুচিন্তার অনুশীলন আগামী দিনের মেধাবী প্রজন্ম গড়তে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক- মো. কামরুল আহসান তালুকদার(পিএএ)