পদ্মার শাখা নদী কুমার অববাহিকায় গড়ে উঠা জনপদ মুকসুদপুর সুপ্রাচীন কাল থেকেই বানিজ্যিক ভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও পরিচিত অঞ্চল। ভৌগোলিকভাবে বিস্তীর্ণ নিন্ম অঞ্চলের মধ্যবর্তী সমতল অবস্থান ও নৌপথে মালামাল পরিবহনের সুব্যবস্থা থাকায় বিশাল এলাকার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সাপ্তাহিক হাট হিসাবে মুকসুদপুর বাজার ব্রিটিশ আমল থেকে দক্ষিনবঙ্গের অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠে। ১৯৬১ সনে থানা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে মুকসুদপুরের প্রশাসনিক কার্যকারিতা ও গুরুত্ব অনেকাংশে বৃদ্ধি পায় যা আশির দশকে উপজেলায় উত্তীর্ণ হওয়ায় সমগ্র এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বরইতলা হয়ে মুকসুদপুর সদরের কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডে রাজধানীর সাথে সরাসরি বাস চলাচল ব্যবস্থার চালু হয়। যারই ধারাবাহিকতায় মুকসুদপুর সদর সমগ্র উপজেলা সহ পার্শ্ববর্তী নগরকান্দা, সালথা ও কাশিয়ানী উপজেলার বিশাল জনগোষ্ঠীর আসাযাওয়া ও সুযোগসুবিধার প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে।
সার্বিকভাবে মুকসুদপুরের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও প্রশান্তিময় পরিবেশ সর্বব্যাপী সমাদৃত। এখানকার বাসিন্দাদের শান্তিপ্রিয়তা ও আন্তরিকবোদ এতোটাই তীব্র যে সরকারি – বেসরকারি কর্মযোগে অথবা আত্মীয়তা সূত্রে মুকসুদপুর সদরে সামান্য কিছুদিন থাকবার সুযোগ পেয়েছেন এমন উল্লেখযোগ্য অংশ এখানেই স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের নজীর বেশ পুরনো। এছাড়া অত্র অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দাদের বহিরাগত অধিবাসীর প্রতি সামাজিক সম্প্রীতি ও অভিন্ন দৃষ্টির মূল্যায়ন আশপাশের অনেক উপজেলা বাসী কে আকৃষ্ট করেছে নিজেদের বাস্তুভিটা মুকসুদপুরে স্থাপনের জন্য। যার দরুন মুকসুদপুরের ভূ-সম্পত্তি অনেকক্ষেত্রেই তুল্যাংকে রাজধানীর নিকটবর্তী এলাকার মূল্যমানের সমানুপাত এবং মুকসুদপুর বাসীর জীবনযাত্রার মানও প্রায় জেলা শহরতলীর সমকক্ষ বা ক্ষেত্র বিশেষ অধিক বটে।
গত কয়েক দশকে এলাকার মাননীয় সংসদ সদস্য মুহাম্মাদ ফারুক খান মহোদয়ের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্ব ও উন্নয়নমুখী সুরাজনৈতিক চর্চায় মুকসুদপুর উপজেলার সর্বত্র ব্যাপক পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সেই সাথে সমগ্র উপজেলা ব্যাপী শতভাগ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতায়ন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং মুকসুদপুর সদরে অবস্থিত মুকসুদপুর কলেজ সহ সাবের মিয়া জসিমউদদীন মডেল উচ্চ বিদ্যালয় সরকারী করণ হওয়ার সুবাদে এলাকার শিক্ষার মান যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তদ্রূপরি সদর হাসপাতাল ১০০ শয্যায় উত্তীর্ণ হবার মধ্যদিয়ে চিকিৎসা সুবিধা অনেক বেশী সূলভ ও সহজসাধ্য হয়েছে। এছাড়াও সরকারি দপ্তর ও অধিদপ্তর সমুহের সেবা প্রদানের গতি ও ব্যাপকতা অধিকতর হওয়ায় বেড়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আয়ত্তা ও সমাজের পিছিয়ে পরা শ্রেনীর সরকারি সুবিধা গ্রহণের প্রবণতা। তাছাড়া নানাবিধ সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগ ও সেবা কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ ইতোমধ্যে পৌঁছেছে প্রত্যাশিত মাত্রায়। যার দরুন সরকারি অফিস চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন দপ্তর সমুহে নিয়মিত ভাবে সেবা প্রত্যাশিতদের চাপ ব্যাপকভাবে লক্ষনীয়।
গত দুই যুগেরও অধিক কাল যাবৎ মুকসুদপুরের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দ্রুত বিকশিত হওয়ায় সদর বাজারে দুই সহস্রাধিক দোকান সহ অসংখ্য বাবস্যা প্রতিষ্ঠান ও বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত উন্মোচিত হচ্ছে বহুজাতিক ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর স্থানীয় সেবা কেন্দ্র বা শাখা অফিস। যার ফলে শেষ ক’বছরে মুকসুদপুরে উদ্ভোদন হয়েছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা, ক্ষুদ্রঋণ সহায়ক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক কার্যালয়, দেশী – আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার নিজস্ব অফিস ও বহু সংখ্যক বীমা কোম্পানি সহ মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট কোম্পানির নিজস্ব সেবা কেন্দ্র৷ এরিমধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মুকসুদপুর সদরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য বেসরকারি ক্লিনিক, উন্নত রোগপরীক্ষাগার ও আধুনিক প্রসূতিসেবা কেন্দ্র। এছাড়াও রয়েছে প্রতিটি মোবাইল নেটওয়ার্ক অপরেটর কোম্পানির গ্রাহক সেবা সেন্টার, নামজাদা ইলেকট্রনিকস কোম্পানির বিক্রয় কেন্দ্র, অভিজাত শো-রুম। যত্রতত্র চালু হচ্ছে রকমারি রেস্তোরাঁ, মিনি চাইনিজ রেস্টুরেন্ট সহ আবাসিক হোটেল। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় পাল্লাদিয়ে বাড়ছে ইন্টারনেট সার্ভিস ও ওয়াই-ফাই সুবিধা যা সমগ্র পৌর এলাকা ছাপিয়ে আশপাশের ইউনিয়ন সমূহ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম গুলি পর্যন্ত সয়লাব। অপরদিকে মুকসুদপুরে রয়েছে বেশ কয়েকটি সংবাদ প্রকাশনা ও তাদের অনলাইন সংস্করণ এবং প্রাত্যহিক তথ্য সরবরাহে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ মাধ্যম সহ একাধিক বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও জাতীয় দৈনিক সমুহের রয়েছে নিজস্ব সংবাদ প্রতিনিধি। এইসমস্ত সুযোগসুবিধা কেন্দ্র করে মুকসুদপুর সদর অঞ্চল বাস্তবিকভাবে প্রশাসনিক গুরুত্ব ও ব্যাবসায়ীক প্রয়োজনীয়তা প্রতিনিয়ত প্রসারিত হচ্ছে। যার দরুন স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ছে আবাসিক চাপ ও সদর কেন্দ্রিকতা। বৃদ্ধি পাচ্ছে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর অত্যাধুনিক উপযোগিতা গ্রহণের মাত্রা ও নিত্যনতুন চাহিদা। যা মোকাবেলায় ব্যক্তি উদ্যোগে মুকসুদপুর সদর সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সবত্র নির্মিত হচ্ছে বহুতল বানিজ্যিক কেন্দ্র ও আবাসিক ভবন। যদিও তা প্রত্যাশা ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই অপ্রতুল। যে প্রেক্ষাপটে ইতোমধ্যে মুকসুদপুর থানা কর্তৃপক্ষ নিজস্ব জায়গায় গড়ে তুলছে দ্বীতল বাণিজ্যিক ভবন। যা চাহিদা অনুপাতে অতি সামান্য হলেও সময়ের প্রয়োজনে অসামান্য কার্যকরী পদক্ষেপ বিশেষ।
ধারণামতে মুকসুদপুর পৌর এলাকায় প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের স্থায়ী – অস্থায়ী বসবাস। সেই সাথে সদর লাগোয়া ইউনিয়ন সমূহ সহ পার্শ্ববর্তী নগরকান্দা ও সালথা উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের বাসিন্দারা প্রাত্যহিক বাজার, বিক্রি, লেখাপড়া, চিকিৎসা সেবা গ্রহন থেকে শুরু করে ব্যাংকিং কার্যক্রম সহ যাবতীয় উপযোগিতা মেটাতে সরাসরি মুকসুদপুর সদর বাজারের উপর নির্ভরশীল। তাছাড়া প্রশাসনিক প্রয়োজনীয়তায় উপজেলাধীন জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত মুকসুদপুর সদরে আসেন এবং নিজস্ব উপযোগিতা মিটিয়ে ফিরে যান।
যে সকল প্রেক্ষাপটে সপ্তাহের কেবলমাত্র শনিবার ব্যতিরেক অন্যান্য সবকয়দিন মুকসুদপুর সদরের প্রধান, প্রধান সড়ক সহ গুরুত্বপূর্ণ চত্ত্বর সমুহে সকাল ৯ টা থেকে বিকেল ৪ ঘটিকা অব্দি জনসমাগম ও যানবাহনের চাপে হয়ে উঠে অচলায়তন। সদর বাজারের কমলাপুর বাসষ্ট্যান্ড থেকে শুরু করে হাসপাতাল রোড, চৌরঙ্গী মোড়, থানা সড়ক সহ কলেজ রোডের সোনালী ব্যাংকের সামনে হতে ফায়ারসার্ভিস পর্যন্ত রাস্তায় যানবাহনের পর্যায়ক্রমিক সারি ও অনিয়ন্ত্রিত যাত্রী উঠানামার ফলে সৃষ্ট জটলায় সাধারণ পথচারী চলাচল হয়ে উঠে বিঘ্নকর। রাস্তা লাগোয়া দোকান সমূহের ইচ্ছেমাফিক রাখা মালামাল, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দখল রাজত্ব ও ক্রেতাদের ভিড় এমনভাবে ফুটপাত গ্রাস করেছে যে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও সামান্যতম দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়া দুস্কর। এছাড়াও সদর বাজারের অপর গুরুত্বপূর্ণ অংশ অর্থাৎ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় সম্মুখ সড়কটি কাঁচাবাজার হয়ে পাটহাটা গলি থেকে পোষ্ট অফিস রোড নামে কাঠপট্টি পর্যন্ত, যেটি মূলত পাইকারী বাজার ও পুরাতন বনিকদের কারবার ক্ষেত্র হওয়ায় সড়কের বিভিন্ন স্থানে মালবাহী ট্রাক, পিকাপ সহ কার্ভাডভ্যান রেখে যত্রতত্র মালামাল উঠানামা করার ফলে অন্যান্য যাত্রীবাহী যান চলাচল হয় চরমভাবে বিঘ্নিত। তাছাড়া এই রাস্তাটি অপ্রসস্থ এবং অনুন্নত হওয়ায় জন দুর্ভোগ অসামান্য।
একটি দ্রুত বিকাশমান সম্ভাবনা সমৃদ্ধশীল হয়ে উঠতে পারে সুষ্ঠু পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সঠিক পদক্ষেপ ও বিদ্যমান সমস্যা সমূহের বাস্তবভিত্তিক সমাধানের পথ ধরে। যাবতীয় প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণে এভাবনা অনস্বীকার্য যে আগামী এক দশকে মুকসুদপুর হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমৃদ্ধ নগর। কারণ পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর থেকে এশিয়ান হাইওয়ের যে অংশটি বৃহৎ কলকারখানা ও শিল্পায়নের জন্য বরাদ্দকৃত তার সিংহভাগ মুকসুদপুর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। যার ফলে মুকসুদপুর উপজেলাধীন বিশ্বরোড সংলগ্ন জায়গা ও তার আশপাশ অঞ্চল সমূহ ইতোমধ্যে দেশীয় শিল্পগোষ্ঠীর কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় যা অচিরেই হয়ে উঠবে অত্যাবশকীয়। কাজেই বৃদ্ধিপাবে শিল্প স্থাপনা, যোগ হবে গ্যাস সুবিধা, তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান ক্ষেত্র। সর্বোপরি বাড়বে মানুষের চাপ, গড়ে উঠবে আবাসিক অঞ্চল যেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নিত্য উপযোগিতা ও প্রয়োজন নিবারনে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে একটি আধুনিক নগর স্থাপন।
অনেক বড় বড় সম্ভাবনা বিনষ্ট হতে পারে সামান্য অবহেলা ও বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে অসচেতনতার দরুন৷ মুকসুদপুরের যাবতীয় সমস্যার মধ্যে বর্তমান অবস্থায় সর্বাধিক যন্ত্রণাদায়ক ও প্রতিনিয়ত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত সমস্যা হচ্ছে যানজট। যা নিবারনে অনতিবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ ও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ একান্ত জরুরী। সেই সাথে প্রয়োজন সুদুরপ্রসারি নগর পরিকল্পনা ও তার সঠিক বাস্তবায়ন। যা না হলে আমাদের সম্মুখে থাকা সমৃদ্ধ মুকসুদপুর গড়ে উঠবার অপার সম্ভাবনা ব্যহত হতে পারে নিজেদের দ্বায়িত্বহীনতা ও উদাসীন সংকীর্ণতার দরুন। বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে যানজট সমস্যা নিরসন সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বিদ্যমান অন্যান্য সমস্যা ও সংকট গুলি দ্রুত চিহ্নিত করে তা সমাধান কল্পে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধি সহ নাগরিক সমাজের যথার্থ ভূমিকা গ্রহন অতি আবশ্যিক। সেই সাথে আমাদের কর্তব্য সচেতন ও দ্বায়িত্বশীল হওয়া একান্ত জরুরী। অবশ্যই সকলের সমন্বিত প্রয়াস ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমৃদ্ধ মুকসুদপুর গড়ে উঠবে এ প্রত্যাশা আমাদের সুদৃঢ়। মহান আল্লাহ পাক সহায় হোন।