পদ্মা সেতু চালুর মধ্যে দিয়ে পূরণ হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের লালিত স্বপ্ন। পদ্মা সেতুর সাথে সংযুক্ত হয়েছে রেলপথ। যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঘটেছে নতুন এক মাইলফলক। তারপরও ফরিদপুরের মানুষের আশা-আকাঙ্খা যেন স্বপ্নই রয়ে গেছে বলে মনে করছেন ফরিদপুরবাসী।
এই পদ্মা সেতুর রেলপথ দিয়ে আগামী ১০ অক্টোবর ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন ভাঙ্গা স্টেডিয়ামে এক জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন তিনি। তবে, ওই সমাবেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দিকে তাকিয়ে থাকবে ফরিদপুরবাসী। এ জেলার সর্বস্তরের মানুষের দাবি উঠেছে, ফরিদপুর নামেই বিভাগ বাস্তবায়ন ঘোষণা এবং জেলা শহরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা করা হোক।
ফরিদপুরবাসী বলছেন, ফরিদপুর একটি পুরানো জেলা শহর। এই জেলায় জন্ম হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, জেলা শহরে রয়েছে তার পদচারণা। এ মাটি অবহেলায় থাকতে পারেনা। ফরিদপুর নামে বিভাগ বাস্তবায়ন এবং জেলা শহরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন অবশ্যই অগ্রগণ্য হওয়া উচিৎ বলে তারা মনে করেন।
তারা জানান, ফরিদপুর বা পদ্মা বিভাগ বাস্তবায়ন করতে হলে ফরিদপুরে অবকাঠামোমূলক উন্নয়ন করতে হবে। এরমধ্যে ফরিদপুরে বিভাগীয় হেডকোয়ার্টার, একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন সরকারি অফিসের দপ্তর, অধিদপ্তর, ক্যান্টনমেন্ট, মহিলা ক্যাডেট কলেজ, ইপিজেড, বিভিন্ন ইন্ডাষ্ট্রি, গ্যাস লাইন ও পদ্মা নদী সংলগ্ন পর্যটন কেন্দ্র করতে হবে।
ইতিহাস ঐতিহ্যে ঘেরা এই “ফরিদপুর”। অনেক গুনি ব্যক্তিদের জন্ম ও পদচারণা রয়েছে এই মাটিতে। অনেক আউলিয়া-দরবেশ, রাজনীতিক, পূণ্যাত্মার আবাসভূমি হিসেবে এ অঞ্চল অত্যন্ত সুপরিচিত। বর্তমানে আরও বদলে গিয়েছে জেলা শহর। আধুনিকতার ছোয়ায় নতুন করে সেজেছে শহর। সুউচ্চ অট্টলিকার শহর। এ জেলাকে ঘিরে বিভাগ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে ১৯৮৫ সাল থেকেই। তৎকালীন “ফরিদপুর বিভাগ এবং পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন” কমিটির মাধ্যমে আন্দোলন শুরু করেন ফরিদপুরের অনেক প্রবীণ ও গুনি ব্যক্তিরা। সে সময়ে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শিক্ষাবিদ প্রফেসর অধ্যাপক এম.এ আজিজ। ২০০৯ সাল পর্যন্ত “ফরিদপুর বিভাগ এবং পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন” কমিটির মাধ্যমে তিনি আন্দোলন চালিয়ে এসেছেন। পরবর্তী পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে ঐ কমিটির নাম দেয়া হয় “ফরিদপুর উন্নয়ন কমিটি”। এই কমিটির মাধ্যমেই ফরিদপুর বিভাগ বাস্তবায়ন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন সহ কয়েকটি উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের দাবিতে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি এই কমিটির সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে কথা হয় প্রবীণ এই শিক্ষাবিদের সাথে। তিনি বলেন- ‘এই অঞ্চলের উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে ১৯৮৫ সাল থেকেই ফরিদপুর বিভাগ বাস্তবায়নের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, প্রেস ব্রিফিং করেছি।
ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর অসীম কুমার সাহা বলেন, ফরিদপুরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। আমরা অনেক দিন যাবৎ বিষয়টি নিয়ে কথা-বার্তা বলে আসছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুই/একবার উত্থাপণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ফরিদপুর জেলা ভেঙে পাঁচটি জেলা হয়েছে। তারমধ্যে গোপালগঞ্জে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশন রাজবাড়ীতে বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। অথচ ফরিদপুরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। আমাদের প্রাণের দাবি, ফরিদপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিৎ। বঙ্গবন্ধুর এই মাটি অবহেলায় থাকতে পারে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করবো, বঙ্গবন্ধুর এই মাটিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা করা হোক।
এই অঞ্চলে শিক্ষার মানোন্নয়নে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন ফরিদপুরের নাগরিক সমাজ। সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি অ্যাডভোকেট শিপ্রা গোস্বামী বলেন, ‘পুরানো এই জেলা শহরে বঙ্গবন্ধুর পদচারণা রয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এই জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া জরুরী এবং বিভাগ বাস্তবায়ন হলে সেটি পদ্মা নামে নয়, ফরিদপুর নামেই হওয়া উচিৎ।
ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, আমাদের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। আশেপাশে অনেক জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করার কথা শোনা যাচ্ছে কিন্তু ফরিদপুরের নাম সেখানে দেখছি না। আমরা অবিলম্বে ফরিদপুরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি জানাচ্ছি। এই অঞ্চলে শিক্ষার ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য ভ‚মিকা রাখবে।
একই দাবি জানাচ্ছেন জেলার সাধারণ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ফরিদপুরকে অবহেলিত জেলা বলে আক্ষেপ প্রকাশ করছেন। তারা মনে করেন, এখানে সবার আগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দরকার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন যেমন আমাদের প্রাণের দাবি তেমনি অবিলম্বে ফরিদপুরকে বিভাগ ঘোষণাও আমাদের দাবি।
এদিকে ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল নিয়ে ফরিদপুর বিভাগ গঠনের বিষয়ে আলোচনা করেন এবং বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশনা দেন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির (নিকার) সভায় পদ্মা নামে নতুন বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরপর ২০২২ সালের ২৭ নভেম্বর একনেক সভায় বিভাগ বাস্তবায়নের ঘোষণা আসতে পারে- এমন আশায় উৎকন্ঠায় দিন কাটে ফরিদপুরবাসীর। কিন্তু ঐ সভায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণ দেখিয়ে পদ্মা বিভাগ বাস্তবায়ন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।
এ বিষয়টি নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামীম হক বলেন, খুব শীঘ্রই বিভাগ বাস্তবায়ন হবে। দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলার উন্নয়নের জন্য পদ্মাসেতু হয়েছে এবং এই অঞ্চলে শিল্পায়নের জন্য পদ্মা বিভাগ বাস্তবায়ন সকলের দাবি। এখন আমরা অপেক্ষায় আছি। তারপরও জনগণের দাবি পূরণে আমি কাজ করে যাবো।’
আক্ষেপ জানিয়েছেন জেলা বিএনপির আহŸায়ক মোদাররেছ আলী ইছা। তিনি বলেন, ‘আমরা পাকিস্তান আমল থেকেই নিগৃহীত। আমাদের এই অঞ্চল শিল্পায়ন নেই, সাধারন মানুষের উন্নয়নে তেমন কিছু নেই। শিক্ষা ব্যবস্থায় জাতীয় পর্যায়ে সেরকম কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। দেশের উন্নয়নে যতকিছু প্রয়োজন, তার থেকে আমরা সব সময়ই বঞ্চিত। আমরা আশায় ছিলাম বর্তমান সরকার বিভাগ দিবে কিন্তু সেটাও আমরা পাইনি।’
ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চ বলছেন, ‘ফরিদপুর বিভাগ হওয়া অবশ্যই অগ্রগণ্য হওয়া উচিৎ এবং বিভাগ বাস্তবায়ন হলে সদর দপ্তর ফরিদপুর জেলা সদরেই করার আমরা দাবি করি। এতে মনে করি, বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান জানানো হবে এবং এই অঞ্চলের মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে।’
উল্লেখ্য, ১৭৮৬ সালে ফরিদপুর জেলা প্রতিষ্ঠালাভ করে (মতান্তরে ১৮১৫)। তখন জেলার নাম ছিল জালালপুর এবং সদরদপ্তর ছিল ঢাকা। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে জেলার সদরদপ্তর ফরিদপুর শহরে স্থানান্তর করা হয়। ফরিদপুরে আসার পরও জেলার নাম ‘জালালপুর’ ছিল। প্রখ্যাত সাধক এবং দরবেশ খাজা মাইনউদ্দিন চিশতী (রহঃ) এর শিষ্য শাহ ফরিদ(রহঃ) এর নামানুসারে ১৮৩৩ সাল থেকে জেলার নাম ‘ফরিদপুর’ ব্যবহৃত হতে থাকে। যা মোঘল আমলে ফতেহাবাদ নামে পরিচিত ছিলো। বর্তমানে ফরিদপুর ভেঙে সৃষ্টি হয়েছে ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরিয়তপুর নামে পাঁচটি জেলা।