ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ও চিকিৎসকদের অবহেলায় নয়ন খান (৯৫) নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটি নিয়ে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের রোগীর স্বজনদের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ১৮ জন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। ঐ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদপুর শহরের চরকমলাপুর এলাকার কমলাপুর এলাকার বাসিন্দা।
সোমবার (০৪ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত দেড়টায় হাসপাতালটির দ্বিতীয় তলায় স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পুলিশ ঐ মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের আহত ৩ সদস্যকে আটক করেছে বলে কোতয়ালী থানার ওসি জানিয়েছেন। বর্তমানে তারা ফরিদপুর জেনারেল হাসপাতালে পুলিশ হেফাজতে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠণ করা হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল আহসান জানিয়েছেন। কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অমিত দেবনাথকে প্রধান করে এবং পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি ও মেডিকেল কলেজের একজন প্রতিনিধি রয়েছেন।
আহতদের মধ্যে মৃতের নাতি আলমগীর বিশ্বাস (২৮), তৌহিদ বিশ্বাস (২৫), আলিফ খান (১৪) ও হামজা খান (২৪), জেসমিন (৪২) ইয়াসমিন (৫০), রেবেকা সুলতানা (৪৫)। এছাড়া ইন্টার্ণ চিকিৎসকদের মধ্যে রয়েছে- পাভেল, ইজাজ, অর্ণব(২৬), মহিন, সাব্বির, রোকন, মাহামুদুল সহ আরো কয়েকজন। তারা সকলে মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
জানা যায়, সোমবার রাত ১১টা ২০ মিনিটে অসুস্থ অবস্থায় মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা নয়ন খানকে। ভর্তির পর অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়। পরবর্তীতে ডাক্তারদের নিকট রোগীর স্বজনেরা অক্সিজেনের কথা জানায়। কিন্তু দায়িত্বরত চিকিৎসকেরা গুরুত্ব না দিলে এক পর্যায়ে তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি কেন্দ্র করে রোগীর স্বজনদের সাথে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের সাথে মারামারি হয়। এ সময় ধারালো বস্তুর আঘাতে এবং মারপিটে উভয় পক্ষের কমপক্ষে ১৮ জন গুরুত্বর আহত হয়। ইন্টার্ণ চিকিৎসকদের পক্ষে বহিরাগত ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অংশ নেয় বলে রোগীর স্বজনেরা অভিযোগ করেন। এছাড়া ঘটনার সময় মৃতের পাশে বসে আহাজারি করতে থাকা তার বয়োবৃদ্ধ স্ত্রী হালিমা বেগমকেও (৮৫) ধাক্কা মেরে সিট থেকে ফেলে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়।
নয়ন খানের নাতি আলমগীর বিশ্বাস বলেন, রাত ১২টার দিকে তার নানার শ্বাস কষ্ট হলে নার্সদের জানাই। তারা ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসককে জানাতে বলেন। এরপর ইমার্জেন্সিতে কর্তব্যরত চিকিৎসককে রোগীকে ওয়ার্ডে যেয়ে একটু দেখার জন্য এবং পরে ন্যুনতম একটু অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু তিনি কোন ব্যবস্থাই নেননি। কিছুক্ষণ পর এসে দেখি আমার নানা মরে গেছেন। এসময় ডাক্তারদের সাথে আমাদের কথাকাটাকাটি হয়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে আমার মা আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে একটি বাথরুমে আটকে রাখেন। এরপর প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো এসে বাথরুম থেকে বের করে আমার উপর হামলা চালায়।
অপরদিকে, এব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইন্টার্ণ চিকিৎসক বলেন, রোগীর স্বজনেরা আমাদের কাছে অক্সিজেন চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের কাছে সরবরাহ করার মতো অক্সিজেন না থাকায় আমরা তাদের বাইরে থেকে অক্সিজেন এনে রোগীকে দেয়ার জন্য একটি ¯িøপও লিখে দেই। কিন্তু এতে তারা রাজি না হলে কথাকাটাকাটি হয়।
হাসিবুল হাসান নামে এক ইন্টার্ণ চিকিৎসক বলেন, রাতে রোগীর অনেক চাপ ছিলো। ঐ সময় ডাক্তার সাব্বির রোগী দেখছিলেন। তাকে রোগীর স্বজনেরা রোগীর অবস্থা জানালে আশংকাজনক দুজন রোগীকে সেবার কাজে ব্যস্ত থাকায় তাৎক্ষণিক যেতে পারেনি। তখনই রোগীর একলোক ডাক্তার সাব্বিরের গলা টিপে ধরে। এরপরেও ঐ রোগী দেখতে গিয়ে দেখেন মারা গেছে। তখন আবারও হামলা করে। এ সময় একজন ফলকাটা চাকু দিয়ে এলোপাতাড়ি কোঁপাতে থাকে। এতে ১০/১৫ জন ইন্টার্ণ চিকিৎসক আহত হয়েছে।
এব্যাপারে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ জলিল বলেন, খবর পেয়ে রাতেই ঘটনাস্থলে পৌছে পরিস্থিতি শান্ত করা হয়। আহতরা আশঙ্কামুক্ত। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনদেরকে থানায় নিয়ে আসা হয়। বর্তমানে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালের চিকিৎসকগণ মিটিংয়ে বসেছেন। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধিন রয়েছে।
এ বিষয়ে ফরিদপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনামুল হক বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিনই কমবেশি ঝামেলা হয়। আমি বর্তমানে ছুটিতে হাসপাতালে বাইরে রয়েছি। তবে গতরাতে একটি মারামারির কথা জানতে পেরেছি। বিস্তারিত জেনে পরবর্তীতে জানানো সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ কামরুল আহসান তালুকদার পিএএ বলেন, ঘটনাটি সকালেই জেনেছি। এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠণ করা হয়েছে। আগামী তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।