প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিক্ষার মূল ভিত্তি। আজকের শিশু যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত তারাই ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এজন্য প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্মার্ট প্রাথমিক শিক্ষা হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। শিক্ষাকে বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তাঁর এক ঘোষণায় ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তাঁর উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে একযোগে প্রায় ২৬ হাজার রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কর্মরত সকল শিক্ষককে জাতীয়করণ করেন। উন্মোচন হয় প্রাথমিক শিক্ষার নব দিগন্ত। জাতীয়করণের ঘোষণার আগে ২০০৯ সালের পর হতে প্রতি বছর ১জানুয়ারি বাংলাদেশের সকল কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে চার রঙের রঙিন পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় আনা হয়েছে। মায়েদের ফোনে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে উপবৃত্তির অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। এতে একদিকে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে ঝরে পড়ার হার হ্রাস পেয়ে মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনে ভূমিকা রাখছে। প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত সবচেয়ে সুদৃশ্য ভবনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন যেখানে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা মনের আনন্দে পড়াশোনা করার সুযোগ পাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় এনে এবং বিদ্যালয়ের জমিজমা ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে পর্যায়ক্রমে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা অর্জন করানোর জন্য বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি লিডারশীপ প্রশিক্ষণ ও আইসিটি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করে ইতোমধ্যে কমপক্ষে এক হতে তিন জন করে শিক্ষককে আইসিটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শূন্যপদগুলো জরুরী ভিত্তিতে পূরণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ অব্যাহত রেখেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতে স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক হিসাবে গড়ে উঠতে পারে এজন্য কারিকুলামে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
পাঠ্যপুস্তকগুলো সময়োপযোগী ও বিজ্ঞান মনস্ক জাতি গঠনের উপযোগী করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লিডারশীপ প্রশিক্ষণ সেন্টার উদ্বোধন করেছেন। মানসম্মত ও গুণগত প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য সরকারের নানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্মার্ট নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার জন্য মাঠপর্যায়ে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। পাহাড়, হাওড় ও চরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিশেষ নজর রাখা জরুরী। হাওড় ও চরাঞ্চলের বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যাতায়াত সুগম না হওয়ায় শিক্ষকদের নিয়মিত উপস্থিতি ও শ্রেণিপাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। কোন কোন হাওড় ও চরের বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে দুই হতে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। আবার দুর্গম হাওড় ও চরে আবাসিক ব্যবস্থা না থাকা এবং চরের বাসিন্দা শিক্ষক হিসাবে কর্মরত না থাকায় সমস্যা প্রকট হয়েছে।
এক্ষেত্রে চরাঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভবন নির্মাণের সময় শিক্ষকদের আবাসিক এক বা একাধিক কক্ষ নির্মাণ করে বিদ্যমান সমস্যাটি সমাধান করা যেতে পারে। যেখানে আবাসিক ব্যবস্থা করা কোনভাবেই সম্ভব নয় এমন চরাঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সময়মত যাতায়াত নিশ্চিত করতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ নৌযানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া চরের হতদরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষাপোকরণ ও প্রয়োজনীয় ইউনিফর্ম বিনামূল্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করলে উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে।
এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। হাওড় ও চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরকে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট কাউন্সিল, কাব ও হলদে পাখির দল কার্যক্রম, ক্ষুদে ডাক্তার দলের মত কিছু চমৎকার ইনোভেটিভ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হলেও সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সমানভাবে কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। সকল কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের এক্ষেত্রে আন্তরিকভাবে কার্যক্রমগুলো বাস্তবায়ন ও মনিটরিং করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের স্মার্ট নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে ইংরেজি ও বাংলা ভাষা ক্লাব স্থাপন, বিজ্ঞান মনস্ক জাতি গঠনের জন্য বিজ্ঞান ক্লাব এবং শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশ ও সুচিন্তার অনুশীলন করার জন্য ডিবেটিং ক্লাব স্থাপন, ও পরিবেশ ক্লাব, ইংরেজি ক্লাব, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্লাব, গ্রীন ক্লাব স্থাপন ও পরিচালনা করা প্রয়োজন।
সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যেন সমানভাবে বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে পঠন দক্ষতা অর্জনসহ শুদ্ধ ভাবে বাংলা ও ইংরেজি শব্দ উচ্চারণ করে কথা বলতে পারে ও লিখতে পারে সেদিকে শিক্ষকদের নজর রাখতে হবে এবং বিষয়টি নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। সরকার যেসকল বিদ্যালয়ে আইসিটি পন্য তথা ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করেছে সেগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিশুদেরকে আইসিটি ডিভাইসগুলোর সাথে পরিচিত করে পর্যায়ক্রমে তাদেরকেও ব্যবহার শেখানো হলে তারা দক্ষ ও স্মার্ট নাগরিক হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪ হতে ১১ বছর বয়সী শিশু শিক্ষার্থীদের বর্তমানে সকাল নয়টা হতে বিকাল সোয়া চারটা পর্যন্ত পাঠদান পরিচালনা করা হয়। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও শারীরিক সক্ষমতা বিবেচনা করে এবং শিক্ষকদের কর্ম ঘণ্টা ঠিক রেখে বিদ্যালয়ের পাঠদানের সময়কাল সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত করা যেতে পারে। প্রত্যেক জেলায় বছরে দুই বার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সম্মেলন করা যেতে পারে। এ ধরনের সম্মেলনে প্রাথমিক শিক্ষা জেলা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা সহজ হবে। একইসাথে সমস্যা গুলো চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় বের করা যাবে। জাতীয়ভাবে বছরে একবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সম্মেলন করা যেতে পারে। জেলার সমস্যাসমূহ জাতীয়ভাবে উপস্থাপন করে সমাধানের সম্ভাব্য উপায় বের করা সম্ভব। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বছরে দুই বার বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ক্যাম্প করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাথে চুক্তি করা যেতে পারে।
সবচেয়ে বড় বিষয় দেশপ্রেম ও সদিচ্ছা। দেশপ্রেম ও সদিচ্ছা থাকলে সীমিত সম্পদের মধ্যেও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনসহ স্মার্ট প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা দূরহ কোন বিষয় নয়। স্মার্ট নাগরিক তৈরীতে স্মার্ট প্রাথমিক শিক্ষাই সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পথ দেখাবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি আমরা সংশ্লিষ্ট সবার উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সহিত পালন করলে আজকের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীরাই আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে এবং নেতৃত্ব দিয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পরিণত করবে। ————লেখক: জেলা প্রশাসক, ফরিদপুর।