সমুদ্র পথে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া আটজনের মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি মাদারীপুরে। তারা রাজৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। আদরের সন্তানদের হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলো।
তারা হলেন রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৯), খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২), একই ইউনিয়নের সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২২), কদমবাড়ির ইউনিয়নের উত্তরপাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২৪), কবিরাজপুর ইউনিয়নের কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার হোসেন (২২)।
বাকি তিনজন হলেন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদি ইউনিয়নের বড়দিয়া গ্রামের দাদন মিয়ার ছেলে রিফাদ (২১), দিকনগর ইউনিয়নের ফতেয়পট্টি এলাকার মো. রাসেল (২০) ও গয়লাকান্দি গ্রামের পান্নু শেখের ছেলে ইসরুল কায়েস আপন (২২)।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্র জানায়, গত ১৪ জানুয়ারি রাজৈর ও গোপালগঞ্জের কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন। পরে তারা লিবিয়ায় অবস্থান করেন। এরপর দালালের মাধ্যমে বুধবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) লিবিয়া থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। ৩২ জন ধারণক্ষমতার নৌকায় ৫২ জনকে নিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন। পথে তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে নৌকার ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। পরে ইঞ্জিনে আগুন ধরে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যায়। এসময় আট বাংলাদেশি যুবক মারা যায়।
উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের সজীব কাজীর বাবা মিজানুর রহমান কাজী বলেন, ধারদেনা করে এ টাকা সংগ্রহ করেছিলাম। এখন পাওনাদার টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে। মানসিকভাবে অসহায় হয়ে পড়েছি। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন হবে। মাসে কিস্তির টাকা কীভাবে দেবো জানি না। ভেবেছিলাম ছেলে ইতালি যেতে পারলে আর দুঃখ থাকবে না।
রাজৈরের খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের নিহত মামুন শেখের বড় ভাই সজিব শেখ বলেন, পাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী। দালাল মোশারফ কাজী প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৩-১৫ লাখ টাকা করে নেয়। পরে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই ইঞ্জিনচালিত নৌকায় লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশ্যে পাঠালে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগী বলেন, জমি, গরু বিক্রি করে, ঋণ করে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে ইতালি যাওয়ার জন্য পাঠাই। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন সত্যি হলো না। সব স্বপ্ন সাগরে শেষ হয়ে গেলো। আমরা একেবারে পথে বসে গেছি। এখন আমরা কি করবো। আমার ছেলে গেলো, সঙ্গে আমাদের সব শেষ হয়ে গেলো। এ ঘটনায় আমরা দালাল মোশারফ কাজীর কঠিন বিচার চাই।
মাদারীপুরের সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য ইয়াকুব খান শিশির বলেন, জেলায় বিভিন্ন সময় অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে প্রাণনাশের ঘটনা ঘটে। তবুও এ জেলা থেকে এভাবে ইতালি যাওয়া বন্ধ হচ্ছে না। এগুলো বন্ধ করা জরুরি।
রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান হাওলাদার বলেন, অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে রাজৈর উপজেলার পাঁচ যুবক মারা যাওয়ার খবর পেয়েছি। ঘটনাটি খুব মর্মান্তিক। এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় দালালচক্র। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা চলমান। সম্প্রতি তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে মাদারীপুরের পাঁচজনসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি মারা গেছেন। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।