ফরিদপুরে আলোচিত কলেজ ছাত্র প্রান্ত মিত্র হত্যাকান্ডে ও জেলা জাকের পার্টির সভাপতি মশিউর রহমান জাদু মিয়ার উপর হামলাকারী একই ছিনতাইকারী চক্র বলে পুলিশ জানিয়েছেন। এছাড়া এই চক্রটি একই রাতে আরো তিনটি ছিনতাই করে বলে পুলিশ জানায়। এসব ঘটনায় তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের মূলহোতা সহ চারজনকে আটক করেছে ফরিদপুর কোতয়ালী থানা পুলিশ। সেই সাথে এক সপ্তাহের মধ্যে চাঞ্চল্যকর প্রান্ত হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে।
গত ২৪শে জুলাই দিবাগত রাত ২টায় হৃদয় নামে এক বন্ধুর বোনকে রক্ত দেয়ার জন্য শহরের ওয়্যারলেসপাড়ার বাসা থেকে বের হয় প্রান্ত মিত্র। পরের দিন ২৫ জুলাই সকালে শহরের আলিপুরের আলিমুজ্জামান ব্রীজের ঢালে আইল্যান্ডের উপর থেকে তার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। একই দিন ভোর ৬ টায় মশিউর রহমান জাদু মিয়াকে কুঁপিয়ে মোবাইল ও টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
আটককৃতরা হলো- মূলহোত ফরিদপুর শহরের গুহলক্ষীপুর এলাকার মোঃ শাহিন শেখের পুত্র মোঃ সজীব শেখ (২৩), জেলা সদরের মমিনখার হাট এলাকার মৃত আবু তালেব মল্লিকের ছেলে ই¯্রাফিল মল্লিক (৩৪), টেপাখোলা এলাকার লিটন বেপারীর পুত্র সিফাতুল্লাহ বেপারী (১৯) এবং মোটরসাইকেল সরবরাহকারী গুহলক্ষীপুর এলাকার মৃত সামাদ শেখের পুত্র মাসুম শেখ (৩৪)। আটককৃতদের নিকট থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, সেভেন গিয়ার চাকু, চাপাতি সহ ছিনতাই হওয়া দুটি মোবাইল উদ্ধার করেছে পুলিশ।
গতকাল বুধবার দুপুর সাড়ে ১২ টায় ফরিদপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব তথ্য জানান পুলিশ সুপার মোঃ শাহজাহান (পিপিএম সেবা)। এ সময় জেলা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে কলেজ ছাত্র প্রান্ত মিত্র হত্যাকান্ড এবং জেলা জাকের সভাপতি মশিউর রহমান জাদু মিয়ার ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ উপস্থাপন করা হয়। পুলিশ সুপার জানায়- বিভিন্ন সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করা হয়। এছাড়া প্রান্ত মিত্র রাতে যে রিক্সায় উঠেছিলো সেই রিক্সাচালককে শনাক্ত করে রহস্য উদঘাটন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান বলেন, কলেজছাত্র প্রান্ত মিত্রের কাছে থেকে মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার সময় ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে প্রান্তের বুকের বাম পাশে পেটের উপরে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেন সজীব শেখ। প্রান্ত মারা গেলে তাকে সড়কের রোড ডিভাইডারের ওপর ফেলে রেখে যায় তারা।
এসপি শাহজাহান বলেন, গ্রেপ্তার সজীব শেখের নামে ছয়টি, ইস্রাফিল মল্লিকের নামে নয়টি, সিফাতউল্লাহ ব্যাপারী ও মাসুম শেখের নামে বিভিন্ন থানায় দুটি করে মামলা রয়েছে।
এসপি বলেন, প্রান্তকে হত্যার পর ওই রাতে শহরের কমলাপুরের তেঁতুলতলা এলাকায় ফরিদপুর জেলা জাকের পার্টির সভাপতি মশিউর রহমান জাদু মিয়াকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন গ্রেপ্তাররা। এসময় তার কাছে থেকে মোবাইল ফোন ও বেশকিছু টাকাও ছিনিয়ে নেয় তারা।
তিনি বলেন, একই রাতে শহরের আলিপুরের বাদামতলী রোডে এক সবজিবিক্রেতা ভ্যানচালকের কাছ থেকে নগদ ৩ হাজার টাকা ছিনতাই করে তারা। এছাড়া, ওই রাতেই শহরের ঝিলটুলী এলাকায় এক মসজিদের ইমামের পথরোধ করে চাপাতি দিয়ে ভয় দেখিয়ে মোবাইল ফোন ও নগদ ৭০০ টাকা ছিনিয়ে নেয় তারা।
তিনি আরো বলেন, তদন্তের শুরুতে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয় একই দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে জেলা পুলিশ, থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি চৌকস দল গঠন করা হয় এবং ঘটনাস্থল ও আশপাশের ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনাসহ বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়।
পরে বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার (০১ আগস্ট) সন্ধ্যা ৭টায় অভিযুক্ত মো. সজীব শেখ ওরফে তানভীর আহমেদ সজীবকে (২৩) ডিএমপির শ্যামপুর থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় উদ্ধার করা হয় চুরি হওয়া মোবাইল সেট। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী একইদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফরিদপুরের মধুখালী থানা এলাকা থেকে আসামি ইস্রাফিল মল্লিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তার কাছে থেকে জাকের পার্টির সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নিকট থেকে ছিনতাই করা স্যামসাং এস ২১ আল্ট্রা মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়। পরে আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এবং তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী একইদিন রাত দেড়টার দিকে কানাইপুরের বাসিন্দা রাজীবের পরিত্যক্ত বাড়ি থেকে ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত একটি সেভেন গিয়ার ছুরি, একটি চাপাতি ছুরি উদ্ধার করা হয়।
ইসরাফিলের দেওয়া তথ্যমতে, আসামি সিফাতকে কোতয়ালি থানাধীন টেপাখোলা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার হেফাজত থেকে সজীবের রক্তমাখা শার্ট ও একজোড়া স্যান্ডেল উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার আসামিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, একইদিন ভোর রাত সাড়ে ৪ টার দিকে অভিযুক্ত মাসুমকে শহরের ভাজনডাঙ্গা টিবি হাসপাতাল মোড় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার হেফাজত থেকে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি ডিসকভার মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মোহাম্মদ ইমদাদ হুসাইন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) শৈলেন চাকমা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) শেখ মো. আব্দুল্লাহ বিন কালাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সুমন রঞ্জন সরকার, কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম.এ জলিল, ডিবির ওসি (কোতোয়ালি জোন) মো. রাকিবুল ইসলামসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন এবং প্রিন্ট-ইলেকট্রিন মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলন শেষে আসামীদের দেখতে হাজির হয় নিহত প্রান্ত মিত্রের মা পুতুল মিত্র। এ সময় আহাজারি করতে করতে বলেন- ‘আমার বাবা সারাজীবন পরের উপকার করতে করতে জীবন দিয়ে চলে গেল। এরকম জীবন যেন আর কারো না যায়। আমি শুধু এই দাবি রাখি- ওদের উপযুক্ত শাস্তি হোক।’
এ সময় পুতুল মিত্র একাগ্রচিত্তে প্রার্থণা করে বলেন- ‘আমি চাই ওদের ফাঁসি হোক। আমার একটাই অনুরোধ, আমার কোল খালি করে ফেলায়ছে, ওগো ফাঁসি হোক। তখন আমার আত্মা শান্তি পাবে। ওরা যখন ধরা পড়ছে, ওগো ফাঁসি হোক। আমি এই কামনাই করি আপনার কাছে। হাত জোড় করে ভিক্ষা প্রার্থণা করে বলতেছি- আমার মতো আর কোনো মায়ের কোল যেন খালি না হয়। আমি আর টিকতে পারতেছি না, আর টিকতে পারতেছি না।’