বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত দুই বছর ধরে ক্রমাগতভাবে কমছে। বর্তমানে দেশের ব্যবহারযোগ্য বা নেট রিজার্ভের পরিমাণ এসে দাঁড়িয়েছে ২১ বিলিয়ন ডলারে। দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০২১ সালের অগাস্ট মাসে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪৮.০৪ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এরপর থেকে বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের যে ধারাবাহিক পতন শুরু হয়, তা আর কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নি।
বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। অবশ্য বাংলাদেশের হিসাবে রিজার্ভ এখন ২৭.৬২ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবৈধ হুন্ডি খেয়ে ফেলছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। তারা বলছেন, বিদেশে শ্রমিক যাওয়া বাড়লেও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে তুলনামূলক কম। হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বেশি আসায় ওইসব ডলার চলে গেছে কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে। এতে কার্ব মার্কেটে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। একই সঙ্গে চাহিদা ও দাম বেড়েছে। কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দাম এখন ১২০ টাকা। যদিও ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রতি ডলারের বিপরীতে প্রবাসীরা প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ২৪ পয়সা পাচ্ছেন।ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলোকে রেমিট্যান্সের বিপরীতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজের ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া বিদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে ব্যাংক হিসাব পরিচালনায়ও অর্থ খরচ হচ্ছে। এতে বাংলাদেশে বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ এখনও সর্বোচ্চ পৌঁছেছে। যে কারণে রেমিট্যান্সের একটি অংশ সার্ভিস চার্জ হিসাবে চলে যাচ্ছে। এতে প্রবাসীদের লোকসান হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অবৈধ হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে প্রবাসীদের অনেকেই। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমছে। হুন্ডিতে ডলারের দাম বেশি পাওয়ার কারণে হুন্ডির জনপ্রিয়তাও বাড়ছে। বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যাদের মাসিক আয় কম এবং যারা অবৈধ অভিবাসী তারা হুন্ডিতেই টাকা পাঠাতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।অবৈধ হুন্ডির পাশাপাশি অনেকেই ঘরে ডলার কিনে রেখেছেন। ডলারের ক্রমবর্ধমান দামও ভবিষ্যতে আরও বাড়বে এই আশায় ব্যাংকে নি¤œ সুদহারের কারণে টাকা ব্যাংকে না রেখে ডলারে সঞ্চয় করছেন।
অনেকে অবৈধ এমটিএফইর মতো অনলাইন বিজনেস করে হুন্ডির আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করতে ফি দিতেও হুন্ডির মাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছেন। এর ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমেছে। এ কারণে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক। আর গত বছর শ্রমিক গেছেন রেকর্ড পরিমাণ ১১ লাখ ৩৬ হাজার। শ্রমিক যাওয়া এভাবে বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। কিন্তু হুন্ডির কারণে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে যাচ্ছে।এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান বলেন, বর্তমান বাজার দরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামের কোনও মিল নেই। এ কারণে অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে বা হুন্ডিতে রেমিট্যান্স বাড়ছে। আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে বাজার দর অনুযায়ী ডলারের বিনিময় হার ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, খোলাবাজার ও নির্ধারণ করা দামের মধ্যে পার্থক্য অনেক বেশি। এই অবস্থা যত দিন চলবে, তত দিন আনুষ্ঠানিক মাধ্যমে আসা প্রবাসী আয় বাড়বে না।এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের দর বাজারভিত্তিক না করার কারণে রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ অবৈধ হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলো যে দর দিচ্ছে, হুন্ডিওয়ালারা তার চেয়ে বেশি দামে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। যে কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডি চ্যানেল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তিনি উল্লেখ করেন, আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক রফতানি বেড়েছে। অথচ রেমিট্যান্স বাড়ছে না।প্রসঙ্গত, বিশ্বব্যাংকের এক বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে দর এক শতাংশ বেশি হলেই সাড়ে ৩ শতাংশ রেমিট্যান্স হুন্ডিতে চলে যায়।বাংলাদেশ ব্যাংকবাংলাদেশ ব্যাংককেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, হুন্ডি বন্ধের বছর তথা ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়, রিজার্ভও সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এই স্ফীতির প্রধান কারণ করোনা মহামারির সময় হুন্ডি ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়েছিল। করোনা চলে যাওয়ার পরের অর্থবছরে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হয়ে ওঠে। তখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলএও) জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্সের ৪০ শতাংশ আসে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাকি ৬০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ নগদ আকারে ও বাকি ৩০ শতাংশ হুন্ডির মাধ্যমে। নগদ আকারে আসা রেমিট্যান্সের প্রায় পুরোটাই হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয়।অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বেশ কয়েক বছর আগে এক অনুষ্ঠানে তার ব্যক্তিগত গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, রেমিট্যান্সের ৪২ শতাংশ আসে হুন্ডির মাধ্যমে। বাকি ৫৮ শতাংশ আসে ব্যাংকের মাধ্যমে।
স¤প্রতি পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেছেন, হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স বেশি আসছে।এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে প্রবাসীরা চলতি মাসের প্রথম ৭ দিনে ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। এই হিসাবে প্রতিদিন রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ৫ কোটি ২৭ লাখ ডলার। যদিও জুলাইয়ের প্রথম তিন সপ্তাহে দৈনিক রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে পৌনে ৭ কোটি ডলার করে। তার আগের মাস জুনে প্রবাসীরা প্রতিদিন পাঠিয়েছিলেন গড়ে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ডলার করে। ওই মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আর সদ্য বিদায়ী আগস্ট মাসে প্রবাসীরা দেশে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ গত মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫ কোটি ১৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনি¤œ রেমিট্যান্স এসেছে আগস্টে। খোলা মুদ্রাবাজারে ডলারের উচ্চ দর থাকায় প্রবাসীদের হুন্ডির মাধ্যমে আয় পাঠানোই এজন্য দায়ী বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগস্টে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে ২১.৫৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের আগস্টে রেমিট্যান্স (বৈধ চ্যানেলে) এসেছিল প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন ডলার।এছাড়া, গত চার বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় এ বছরের আগস্টেই সর্বনি¤œ পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে।